‘বাঙালি রাজগণের মধ্যে শশাঙ্কই প্রথম সার্বভৌম নরপতি।’ – আর সি মজুমদার।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের অরাজগতার মধ্যে এক সামন্ত রাজা ক্ষমতার শীর্ষে উঠে সার্বভৌম গৌড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করলেন। তার বংশ পরিচয় কিংবা শৈশব অজানা। তার সময়কার আবিষ্কৃত মুদ্রা থেকে তার নাম জানা যায় নরেন্দ্রগুপ্ত। মুদ্রার নকশায় গুপ্ত যুগের সামাঞ্জস্যতা পাওয়া গেলেও এসব পরোক্ষ নিদর্শন ছাড়া প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ নেই। কিছু কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন তিনি গুপ্ত রাজবংশের সদস্য, তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরাই তাকে গুপ্ত সম্রাটের অধীন সামন্ত রাজা হিসেবেই মনে করে থাকেন। আনুমানিক ৬০৬ খ্রিষ্টাবে শশাঙ্ক গৌড়াধিপতি হন এবং কর্ণসুবর্ণে রাজধানী স্থাপন করেন। গৌড় বাংলার উত্তর ও পশ্চিম অংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিল আর বঙ্গ দক্ষিণ পূর্ব অংশে। বঙ্গের কতদূর পর্যন্ত গৌড়ের সীমা বিস্তৃত ছিল সেটা অনিশ্চিত।
বহিরাক্রমণ থেকে গৌড়কে সুরক্ষিত করতে শশাঙ্ক প্রাকৃতিক সীমাকেই বেছে নিয়েছিলেন। গৌড় পূর্বের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে পশ্চিমের শোন-গন্ধক পর্বতশৃঙ্গ পর্যন্ত এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
হর্ষবর্ধন ভারতের ইতিহাসের একজন সুপরিচিত শাসক। তিনি থানেশ্বরের যুবরাজ ছিলেন যখন তার বোন রাজশ্রীর বিয়ে হয় কনৌজের রাজার সাথে এবং দুই রাজ্য বন্ধু-রাজ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীতে যখন হর্ষবর্ধনের পিতা, থানেশ্বরের রাজা, মারা গেলেন তখন কনৌজের শাসক দূর্বল হয়ে পড়লেন। শশাঙ্ক এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কনৌজে আক্রমণ করলো। মালবরাজ দেবগুপ্তের সাহায্য নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে কনৌজ রাজা গ্রহবর্মনকে হত্যা করে রাজশ্রীকে বন্দি করলেন। এ খবর থানেশ্বরে পৌঁছার সাথে সাথে হর্ষের বড় ভাই রাজ্যবর্ধন রাজ্যভার হর্ষের উপর অর্পণ করে শশাঙ্গের উদ্দেশ্যে অগ্রগামী হলেন। প্রথমে মালব রাজ্য আক্রমণ করে দেবগুপ্তকে পরাজিত করে তার সৈন্যদের বন্দি করলেন। কিন্তু রাজশ্রীকে উদ্ধার করতে কনৌজ পৌঁছলে শশাঙ্কের কাছে নিহত হন। কিভাবে রাজ্যবর্ধন নিহত হয়েছিলেন সে নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বানভট্টের মতে রাজ্যবর্ধন শত্রু ভবনে নিরস্ত্র ও ছদ্মবেশে ঘুরছিলেন, সে সময় শশাঙ্কের হাতে ধরা পড়েন এবং নিহত হন। হিউয়েন সাং এর মতে সে তার মন্ত্রীগণের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হয়েছিলেন।
হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করে অনতিবিলম্বে শশাঙ্কের বিরূদ্ধে যুদ্ধে এবং নিজ বোন রাজশ্রীকে উদ্ধার করতে রওনা হলেন। কামরূপ এর শাসক ভাস্করবর্মা হর্ষের সাথে মিত্রতা করে। ফলে পশ্চিম থেকে হর্ষবর্ধন ও পূর্ব থেকে ভাস্করবর্মার দুই বাহিনী আক্রমণ করে। এই যুদ্ধের ফলাফল নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। শশাঙ্ক যদিও মারা যায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তার অনেক আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। শশাঙ্কের পরবর্তী মুদ্রা গুলোর মান খুব নিম্ন মানের হওয়া থেকে তার আর্থিক অবনতির ধারণা পাওয়া যায়। আর সি মজুমদার ও অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা মনে করেন এই যুদ্ধে হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্যের তেমন কোন ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। হিউয়েন সাং লিখেছিলেন ৬৩৭ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মগধ তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং হর্ষের দ্বারা গৌড় আক্রমণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ থেকেই শশাঙ্কের গৌড়ে একচ্ছত্র শাসনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সে যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন গৌড় অবিচ্ছিন্নভাবে শাসন করেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্ধন শশাঙ্কের পুত্র মানবদেবকে পরাজিত করে গৌড় ভাগ করে নেয়।
শশাঙ্ক শিব ভক্ত ছিলেন। তার মুদ্রায় শিবের মূর্তি খোদিত ছিল। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৬৩৭-৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হিউয়েন সাং যখন মগধ ভ্রমণ করতে এসেছিলেন তখন তিনি শশাঙ্কের বিহারে বোধি-বৃক্ষ ছেদনের খবর পান। নিকটবর্তী মন্দির থেকে বুদ্ধ মূর্তি সরানোর নির্দেশও দেন। পরবর্তীতে সে বছরই শশাঙ্ক মারা যান। অর্থাৎ ৬৩৭ সাল পর্যন্ত বিহার শশাঙ্কের শাসনের আওতায় ছিল। শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যদিও গ্রন্থাবলী শশাঙ্কের বিপক্ষে যায়, কিন্তু বানভট্ট ও হিউয়েন সাং উভয়ই ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। বানভট্ট ছিল হর্ষের সভাকবি, আর হিউয়েন সাং হর্ষের দ্বারা উপকৃত। শশাঙ্কের এমন কোন লেখক ছিল না যে তার কৃতিত্বের কথা নথিভুক্ত করবে। তার সম্পর্কে সকল ইতিহাস তার শত্রুপক্ষের দলিল থেকে সংগৃহীত। ডি আর পি চন্দ্র ও আর সি মজুমদার তার বৌদ্ধ বিদ্বেষের বিপক্ষে গিয়েছেন। তাদের মতে এ বিষয়ে অতিশয়োক্তি রয়েছে, যেহেতু সকল নথিই তার বিপক্ষ দলের এবং যেহেতু হর্ষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন সেহেতু রাজনৈতিক কারণেও শশাঙ্ক এরূপ কাজ করতে পারে।
শশাঙ্কের পূর্বে বাংলার ইতিহাস ছিল অস্পষ্ট ও বিক্ষিপ্ত। এ দেশে এর আগে কোন শাসক এমন শক্তিশালী ও সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল উল্কার মতো আবির্ভাব ঘটে শশাঙ্কের। রাজ্য বিস্তারের যে কৌশল তিনি দেখিয়েছেন তা পরবর্তীতে পাল শাসকরাও অনুসরণ করেছে। অজানা অস্তিত্ব থেকে উঠে এসে নিজ ক্ষমতার বলে শশাঙ্ক গৌড় সাম্রাজ্যের মত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারি হন। সে কর্ণসুবর্ণকে গৌড়ের সমৃদ্ধশালী রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। দূর্ভাগ্যবশত তার সভায় বানভট্টের মতো কবি বা হিউয়েন সাং এর মতো পর্যটক ছিল না যারা তার কৃতিত্ব নথিভুক্ত করবে, যদিও তার জনসেবার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। তার মৃত্যুর পর যদিও গৌড় তার নিজস্বতা হারায়, কিন্তু তার জীবদ্দশায় গৌড় অবিচ্ছেদ্দ ও অপরাজিত রাজ্য ছিল প্রায় তিন দশক পর্যন্ত। শশাঙ্ক বিচক্ষণ কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন যে মৌখরি রাজবংশকে কূটনীতির সাহায্যে পরাজিত করেছিলেন। বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছেন। বাংলার রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বাংলার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কারণে শশাঙ্ককে বাংলার প্রথম জাতীয় রাজা বলে অভিহিত করা হয়।
תגובות