top of page
Search
Writer's pictureHistory and Tales

৫২ বাজার ৫৩ গলি: ঢাকার গল্প


প্রায় নয় শতাব্দী পূর্বে সেন রাজা বল্লাল সেন এসে নামলেন বুড়িগঙ্গার তীরে। সেসময় বুড়িগঙ্গার দুপ্রান্তে গাছপালা ছিল খুব। জঙ্গলে ঘুরতে থাকা অবস্থায় রাজা একটা দূর্গা মূর্তি দেখতে পেলেন। সেটাকে এ অবস্থায় দেখে সে সিদ্ধান্ত নিলেন সেখানে একটা মন্দির করবেন। তার লোকদের আদেশ দেওয়া হলো এবং যথাযথ সেখানে একটা মন্দির উঠে গেলো। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে থাকায় সেটা সাধারণ লোকের চোখের আড়ালে পড়ে থাকে। ফলে মন্দিরটির নাম হয়ে উঠলো ‘ঢাকা ঈশ্বরী’, তারপর সেখান থেকে ‘ঢাকেশ্বরী’ মন্দির। বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় হিন্দু মন্দির যেখানে হাজারো ভক্তরা উপস্থিত হয় এবং এ থেকেই শহরের নাম হয় ‘ঢাকা’।

কিন্তু এটা শুধু একটা উৎস। এরকম আরো অনেক কথা আছে ঢাকার নামকরণ নিয়ে। ইসলাম খাঁ চিশতি, চতুর্থ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের প্রেরিত সুবেদার, ঢাকায় যখন প্রথম এলেন, তিনি কয়েকজন ঢাকিদের ডাকলেন ঢাক বাজাবার জন্য। ঢাক এক ধরণের বাদ্যযন্ত্র যেটা ড্রামের মত গলায় ঝুলানো থাকে। বাজাতে হয় দুটো কাঠি দিয়ে। সে সময় ঢাকায় প্রচুর ঢাকি ছিল। ইসলাম খাঁ ঢাকিদের ঢাক বাজাতে বললেন আর তার চারজন অনুচরকে বললেন চারদিকে হাঁটতে শুরু করতে। যতক্ষণ পর্যন্ত ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাবে ততক্ষণ হাঁটতে হবে। যেখানে আর শব্দ শোনা যাবে না সেখানে থামবে, আর সেটাই হবে ঢাকার সীমানা। এই ঘটনা থেকেই নাকি ঢাকার নাম হয় ঢাকা।

কেউ বলে ঢাকার নাম হয়েছে ঢাক গাছ থেকে। আবার কেউ বলে এক সময় এখানে ছিল একটা বন্দর, নাম ‘ঢাক্কা’। সেই ঢাক্কা থেকেই ঢাকা। এরকম আরো অনেক গল্পই আছে ঢাকার নামকরণ নিয়ে। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার, সেটা হলো বুড়িগঙ্গার তীরে এক বিরাট সম্বৃদ্ধ জনপদ ছিল এককালে। ঢাকার একটা খুব পুরনো নাম হলো ৫২ বাজার ৫৩ গলি। এটা থেকে বুঝা যায় এ শহরে আগে প্রচুর গলি ছিল এবং প্রায় প্রতিটা গলিতেই একটা করে বাজার বসতো। ব্যবজা বাণিজ্যও খুব হতো এখানে। নদীর মাধ্যমে অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো এখানকার লোকেরা।

ঢাকা অনেক বিখ্যাত রাজবংশের অধীনে ছিল। পাল ও সেনদের মতো রাজবংশ, যারা স্থাপত্যশিল্প ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য সুপরিচিত, তারাও ঢাকার শাসক ছিল। মুসলিম শাসকরা ঢাকায় বিশাল ইমারত, প্রাসাদ, দূর্গ ও বিস্তির্ণ বাগান করেছে। বিভিন্ন স্থানের নামের শেষে ‘বাগ’, ‘বাগিচা’, ‘গঞ্জ’ ইত্যাদি এখনো মুঘলদের ইতিহাস বহন করে। সুবেদার আজম শাহের সময়ে নির্মিত ‘লালবাগ কেল্লা’ পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে ইংরেজদের শাসনভার দখলের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুঘল সুবেদাররা ঢাকার দায়িত্বে ছিল। সুবেদারদের পর ইংরেজদের সময় ছিল ‘নায়েব-নাজিম’ যারা সাধারণ মানুষের কাছে ‘নবাব’ বলেই পরিচিত ছিল। তবে তারা শুধু ছিল নামমাত্র সরকার। আসল শাসনভার ছিল ইংরেজদের হাতে। ‘আহসান মঞ্জিল’ ছিল নবাবদের বাড়ি। জমিদার ও বণিকরা শহরের উপরের শ্রেণীর বলে গণ্য হতো। বাকি শ্রমীকরা সব নিচু শ্রেণীর। সে সময় এই শ্রেণীবিভাগটা ঢাকার একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল।

ঢাকা ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ভারত কিংবা প্রাচ্যের দেশ গুলোই না, ইউরোপিয়ানরাও এই শহরের সম্বৃদ্ধির দিকে আকৃষ্ট ছিল। শুধু ইংরেজরাই না, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফ্রেঞ্চ, আর্মেনিয়ান, গ্রিক বণিকরাও এসেছে এ শহরে। শুধু তাই না, অনেকে এখানকার মানুষের সাথে মিশেও গেছে পুরোপুরিভাবে। তারা অনেক চার্চ, স্মৃতিস্তম্ভ, স্কুল, বাণিজ্য কুটির ও বসতিও করেছে। ‘আর্মেনিটোলা’ এখনো আর্মেনিয়ানদের স্মৃতি বহন করে চলছে।

১৯৩৬ সালে চন্দননগর থেকে (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) দুটো রিক্সা নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। সেই থেকেই ঢাকায় রিক্সার চল। বর্তমানে রিক্সা ছাড়া ঢাকাকে কল্পনাই করা যায় না। রিক্সার আগে ছিল ঘোড়ার গাড়ি। ঠেলাগাড়ি ছিল পণ্য আনা নেয়ার জন্য। একজন আর্মেনিয়ান লোক ১৮৫৬ সাথে এই ঠেলাগাড়ির আবির্ভাব ঘটান ঢাকায়। এদিক সেদিক দেখা যেতো হাতি চড়ে বেড়াচ্ছে কাঁধে একটি করে মাহুত বসিয়ে। তারপর রেলগাড়ি ভেঁপু বাজাতে শুরু করে ১৮৮৫ সালে। প্রথম টেলিফোন বেজে ওঠে ১৮৮২ তে। আর বিশ শতাব্দীর প্রথম বছরেই ঢাকায় জ্বলে ওঠে প্রথম বৈত্যুতিক বাতি।

বিশ্বের সবথেকে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের তালিকায় ঢাকা অনেক পরিচিত একটা শহর হলেও এটার ইতিহাস অতটা পরিচিত না। এ বিষয় নিয়ে খুব অল্পই চর্চা হয়েছে, যার ফলে মানুষ এর অতীত সম্পর্কে এখনো অনেক অজানা। বর্তমান শহর সম্পর্কে একেক জনের ধারণা একেক রকম হতে পারে, কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে, তারা যদি এর ইতিহাস সম্পর্কে শিখতে পারে তাহলে এর প্রায় প্রতিটা বিষয়েই আরো যত্নশীল হয়ে উঠবে; যেটা একটা বড় ধরণের অগ্রগতি। কারণ ইতিহাসের সম্পর্কে ধারণা ও ইতিহাস থেকে পাওয়া শিক্ষা ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করবে।

131 views0 comments

Comments


bottom of page